তাঁর প্রতিদিনের খাবার ছিল হিটারে রান্না করা ভাত; সাথে আলু-কলা-ওল অথবা ডাল ভর্তা। প্রতিদিন অসহ্য একই মেন্যু! আর সারাদিন পড়াশুনা। অথচ তার রুমমেটরা দিব্বি প্রাইভেট পড়িয়ে; প্রচুর টাকা আয় করে গার্লফেন্ড নিয়ে চাইনিজ খাচ্ছে! নওগাঁ’র কোন এক প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার বাবার নিকট থেকে পাঠানো; মাত্র ১ হাজার টাকাতেই ২০০৩-৪ এর দিকে দিন পার করতেন তিনি।
বাবার সাথেও মুকুল ভায়ের সর্ম্পক ভাল ছিল বলে মনে হত না। প্রায় কাঁচা-পাকা দাঁড়িওয়ালা মুরুব্বী বিভিন্ন পত্রিকা নিয়ে আসতেন এবং মুকুল ভাইকে বিভিন্ন চাকুরির আবেদন করতে বলতেন। কিন্তু মুকুল ভাই অন্য দিকে মনোযোগ না দিয়ে শুধু বিসিএস এর জন্য তার আগ্রহের কথা জানাতেন। মুরুব্বী প্রায় রাগান্বিত হয়ে চলে যেতেন এবং আর টাকা না পাঠানোর হুমকি দিতেন। মুকুল ভাইয়ের বয়স শেষ হতে তখন মাত্র কয়েকটি মাস বাকি। তাই তাঁর বাবার এত কাতরতা।
প্রতিবারই মুকুল ভাই অসহায় চোখে বাবার গমনকে প্রত্যক্ষ করে আবার পড়তে বসতেন। মুখের দিকে চেয়ে মনে হত; বাবার ধিক্কারগুলো তাঁর কলিজাকে বির্দিণ করে দিয়েছে; হতাশায় হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে ।
তার মা’ও কয়েকবার তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু তিনি যেতেন না। আমাকে বলতেন; “বাড়িতে সব হবে কিন্তু পড়াশুনা হবে না। আমি তাকে বাড়ি যাওয়ার কথা বললেই মুকুল ভাই বলতেন, “ভাই এলাকাতে সবাই আমাকে বেকার বলে। খেতে বসলেই প্রতি লোকমা খাবারের পূর্বে বাবার কথা শুনতে হয়। আত্মীয়-স্বজন সকলেই বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে বেকারত্বের জন্য হেয় করে।
কেউযখন আমাকে জিজ্ঞাসা করে; আমি এখন কি চাকুরি করি? তখন লজ্জা ও হতাশায় আমি কাতর হয়ে পড়ি ভাই। এই কারণে আমি এলাকাতে থাকি না। এখানে চুপচাপ পড়াশুনা করি”। ক্যারিয়ারের শেষ মুর্হুতে এসে মুকুল ভাইয়েরও চোখে মুখে সর্বদা শঙ্কা-ভয়-দু:চিন্তা কাজ করত।
কিন্তু তিনি বলতেন, “আমি যতক্ষন হার মানব না; ততক্ষণ কেউ আমাকে পরাজিত করতে পারবেনা”। কিন্তু ২৬ থেকে ২৯ বছর ধরে মুকুল ভাই দিনরাত পড়াশুনা করছেন এবং রীতিমত পরাজিত হয়ে আসছেন!! এসএসসি ও এইচএসসি’তে স্টার পাওয়া রাজশাহী ইউনিভার্সিটির এমন মেধাবী একজন ছাত্রের সম্ভাব্য পতন; বাবা-মা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
২৭তম বিসিএস ছিল মুকুল ভাইয়ের লাস্ট বিসিএস। যে দিন প্রিলির রেজাল্টে মুকুল ভাই টিকল; সেদিন মুকুল ভাইয়ের বয়স শেষ। দিন নাই, রাত নাই মুকুল ভাই সমানে পড়ছে। মেসের সবাই মুকুল ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করত। এবার মুকুল আদুভাই কিছু করবে। রিটেনের রেজাল্টেও মুকুল ভাই টিকলো। ভাইভার ডেটের পূর্বে মুকুল ভাইয়ের আব্বা মুকুল ভাইকে নিউমার্কেটে নিয়ে যাবে!! মুকুল ভাই পছন্দ করার জন্য আমাকেও সাথে নিল।
সিগ্ধ চেহারার মুকুল ভাইকে, তার বাবা সাদা সার্ট-কালো প্যান্ট আর নীল রঙের টাই এবং কাল জুতা কিনে দিয়েছিল। মুকুল ভাইয়ের কন্ঠে সেদিন প্রথম গুনগুন শুনেছিলাম; ‘চাকুরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ’। হায় রে!! হয়ত এমন নীরস লোকেরও কোন সখিনা আছে। তাকে যে কত আশা দিয়ে, কত স্বপ্ন দিয়ে ধরে রেখেছে আল্লাই জানে??
ভাইভার দিয়ে ঢাকা থেকে আসার পর মুকুল ভাইয়ের হাসিমাখা মুখ দেখার মত ছিল। তার মাকে বলেছিলেন, “এবার বিসিএস-এ যদি একজনকে টিকাই তবে সেটি হব আমি”। কত স্বপ্ন নিয়ে যে মুকুল ভাই বসেছিল আল্লাহই জানে। ফাইনাল রেজাল্টের খবর শুনে, তার বাবা রাজশাহীতে ছুটে এসেছেন। রেজাল্টের ফটোকপি বের করা হলো;
কিন্তু হাই! মুকুল ভাই ব্যর্থ। ভাইভাতে পাশ করতে পারেনি। কোন কথা না বলে কাঁপতে থাকে মুকুল ভাইয়ে বাবা, ছাতাটা হাতে নিয়ে রিক্সাতে ওঠে। আর মুকুল ভাইয়ের চেহারার দেখে মনে হচ্ছিল সদা মৃত্যদন্ড পাওয়া একজন খুনি।
দুই/তিন দিন আর মুকুল ভাইকে দেখিনি। ৩দিন পড়ে যখন দেখলাম, তখন একটি কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললেন, “আপার নিকট থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসেছি। তোমাদের মোড়ে ঐ ফাঁকা জায়গায় চায়ের দোকান দিব”। কাতর ভাবে আমার দুই হাত জড়িয়ে ধরলেন; “আমাকে ঐ ফাঁকা জায়গার টুকুর ব্যবস্থা করে দাও। হতভম্ব আমি কি বলব!!! যদি দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্স্টাস পাস মেধাবী ছাত্র এমন বলে!!!
চাটাই আর টিনে ছাপরা দিয়ে ছোট হোটেল খুললেন তিনি। ১ মাস পরে বিকালে চা খেতে গিয়ে লোকটিকে চিনতে পারলাম। মুকুল ভাইয়ের বানানো চা খাচ্ছেন, মাথা হেট করে থাকা হেড মাস্টার সাহেব; চোখের পানিতে দাঁড়ি বেয়ে বুক ভিজে যাচ্ছে। হয়ত ভাবছেন; হাইরে আমার সন্তান, আমার স্বপ্ন!! এসএসসি এইচএসসিতে স্টার পাওয়া-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্স্টাস করা আমার সন্তান; চা বিক্রেতা সেজেছে!!!
মুকুল ভাইকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য শত জোরাজোরি করার পরও মুকুল ভাই গেল না। মাস্টার সাহেব জোড় হাত করে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন আমি যাতে তাকে বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করাই।
সেই দিন কেবল মাত্র আমি মুকুল ভাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। শুধু আমি নই;মেসের সবাই বকাবকি করলে মুকুল ভাই একেবারে নীথর-নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। শূণ্য রুমে নীরব আমি আর নিস্তব্ধ মুকুল ভাই। এক সময় ক্ষীপ্ত হয়ে আমি বললাম, “মুকুল ভাই আপনার মত নির্লজ্জ-বেহায়া এবং ক্যালাস লোক আমি কোন দিন দেখিনি”।
আমার কথাটি তীব্রভাবে মুকুল ভাইকে আঘাত করেছিল। তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন প্রথম বারের মত। কাতর ভাবে বললেছিলেন; “আমার ক্যারিয়ার নিয়ে যদি সকলের এত দু:চিন্তা হয়, আমার বিসিএস না টিকা নিয়ে যদি তোমরা এত কষ্ট পাও; তবে যে মুকুল ভাই বছরের পর বছর নিজের সকল আনন্দ-বিনোদন-ইচ্ছাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, অমানুষিক কষ্ট করে পড়েছে; তবে সেই মুকুল ভাইয়ের কেমন লাগেতে পারে??? তা কেন একবার ভাবনা”?? !!
করুন কন্ঠে মুকুল ভাই বলেছিলেন, “আমি মুকুল নামের এই ব্যক্তিটিকে খুব সম্মান করি। কারণ যখনই আমি আয়নার সামনে দাঁড়ায়; তখন নিজের মাঝে প্রাণ উজাড় করে পরিশ্রম করা একজন যোদ্ধার প্রতিকৃতি দেখতে পাই। আল্লাহ যদি আমাকে আরেকবার জন্ম নেওয়ার অপসন দেই এবং বলে তুই কোন ব্যক্তি হিসেবে জন্ম নিতে চাস?? তবে আমি বারবার মুকুল হিসেবেই জন্ম নিতে চাইব। বিল গেটসও না, নিউটনও না, অ্যারিস্টেটলও, আব্রাহাম লিংকনও না। কারণ আমি পরাজিত হলেও হার মানিনি”।
সেদিন তার নিজের প্রতি আন্তসম্মান বোধ দেখে, আমার চোখেও পানি এসেছিল।
২৭তম বিসিএস দূর্নীতির কারণে সরকার বাতিল করে দিল। আবার ভাইভা দিয়ে মুকুল ভাই ফরেন ক্যাডার হিসেবে পররাষ্ট্রে জয়েন করলেন। তবে যেদিন তিনি আমার চাচাদের মেস থেকে হাসিমুখে বাবার সাথে যাচ্ছিলেন; সেই সময় তাঁর দূর্দিনের লড়াইয়ের তুচ্ছ সঙ্গী চা’য়ের দোকানটি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছিল। দোকানটির ভাঙ্গা চাটাই ও টিনগুলো দেখে মুকুল ভাই আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না; বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ছিলেন মুকুল ভাই।
মুকুল ভাই আজ আপনি কোথায়? কোন দেশে? বিশ্বের কোন প্রান্তরে থেকে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন জানিনা। কারণ তখন আমার মোবাইল ছিল না; আপনারও না। যেখানেই থাকুন; কান পেতে শুনুন। আমি আজ আপনার মেঘনাদের মত লড়াকু ব্যক্তিত্ব, হেক্টরের মত মানবীয় সাহসকে কে হাজার হাজার ক্যাডার প্রত্যাশীদের নিকট তুলে ধরছি। তাদের মাধ্যমে হাজার হাজার ক্যাডার প্রত্যাশী উজ্জিবিত হবে এবং আপনি তাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
তাই মুকুল ভাইয়ের মত লড়াই চালিয়ে যান; তাহলে আজ যারা আপনাকে বেকারত্বের জন্য Neglect করছে; কাল দেখবেন আপনার ক্যাডার হওয়ার পর; তারা আপনাকে নিয়ে Celebrate করবে। ততদিন মুখবুঁজে লড়াই চালিয়ে যান।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন