বিসিএস ক্যাডার হিমেলও বাবার অনুপ্রেরণা


ডা. হিমেল ঘোষ খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার। বাবা ডা. প্রদীপ কুমার ঘোষ, মা বরুনা ঘোষ। তিনি ১৯৯৫ সালের ২০ ডিসেম্বর খুলনা সদরে জন্মগ্রহণ করেন। খুলনা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি, সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
ডা. হিমেল ঘোষ: ছোটবেলা থেকেই আসলে শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা। স্কুল ও কলেজ জীবন খুলনা শহরেই কেটেছে। ছোটবেলা থেকে গল্পের বই পড়ার একটা ঝোঁক ছিল। কলেজ জীবন শেষ হওয়ার আগেই কাকাবাবু, ফেলুদা, শার্লক হোমস, হ্যারি পটার, প্রফেসর শঙ্কু, টেনিদা, ঘনাদা, ব্যোমকেশ, কিরীটি, মিসির আলী, হিমুসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, জুল ভার্ন প্রমুখ সাহিত্যিকের অনেক লেখাই পড়া হয়ে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই বাগান করা ও পোষাপ্রাণির অনেক শখ ছিল। এছাড়া হারমোনিয়াম এবং গিটারের প্রতিও ঝোঁক ছিল। অন্য সবার শৈশবের মতো আমারও কেটেছে নির্মল আনন্দে। আমার ছেলেবেলা ছিল অসম্ভব সুন্দর ও আনন্দময়। বাবা-মা পড়াশোনার ব্যাপারে কোনদিন তেমন চাপ দেননি। তবে আমার পড়াশোনার প্রতি তারা অনেক সচেতন এবং যত্নবান ছিলেন। ছবি আঁকা, গান, বাগান করার মধ্যদিয়ে একটি চমৎকার ছোটবেলা কেটেছে। তবে আমার একটি খারাপ দিক ছিল যে, রুটিন মেনে চলা প্রায়ই সম্ভব হয়ে উঠত না। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কোন পরীক্ষার ফলাফলে এর প্রভাব কখনো পড়েনি।

পড়াশেনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
ডা. হিমেল ঘোষ: আমি আসলেই অনেক ভাগ্যবান যে, লেখাপড়ার ব্যাপারে কখনোই আমাকে পারিবারিক বা অর্থনৈতিক কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমার বাবা-মায়ের লক্ষ্যই ছিল আমাকে উচ্চশিক্ষা ও মানবিক গুণাবলীর সমন্বয়ে সৎ ও আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। আমার বাবা গ্রামীণ কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে, অনেক সংগ্রাম করে ডাক্তার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সারাজীবনই তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তাই বাবা-মা সব সময়ই চাইতেন, তারা যে প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এ পর্যায়ে এসেছেন; এ রকম কোন প্রতিবন্ধকতা যেন আমাকে মোকাবেলা করতে না হয়। এজন্য সব সময়ই তারা আমাকে সব ধরনের সাপোর্ট দিয়েছেন। স্কুল-কলেজ জীবনে সব সময়ই রোল এক হিসাবে আমার সুপরিচিতি ছিল। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভের পর এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে জিপিএ-৫ অর্জন করে দেশসেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ পাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকেও মেডিসিন বিষয়ে অনার্স নম্বরপ্রাপ্ত হয়ে কৃতিত্বের সাথে চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাবার পর আমিও পরিবারের দ্বিতীয় চিকিৎসক হিসাবে জনগণের সেবা করার সুযোগ পেয়ে যাই।


বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
ডা. হিমেল ঘোষ: আসলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন আমি তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত, তখন থেকে একটু একটু করে আমার বিসিএসের স্বপ্ন দেখা শুরু। স্কুল জীবন থেকে চিকিৎসক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুপ্ত ইচ্ছা থাকলেও সরকারি চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্ব পালনের স্বপ্নের সূচনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ই। এ সময়ই আমি লক্ষ্য করি যে, একজন চিকিৎসক হিসাবে জনসেবার সুযোগ পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি এবং সরকারি চিকিৎসক হিসাবে জনসেবার পাশাপাশি জনকল্যাণ ও জনদায়বদ্ধতার কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের সান্নিধ্যে আসা যায় সবচেয়ে বেশি। আর আমাদের দেশে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা শহরের তুলনায় এখনো পিছিয়ে। এসব বিষয় বিবেচনা করে জনকল্যাণকর একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি চিকিৎসক হিসাবে স্বপ্ন দেখার সূচনা হয়।


বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
ডা. হিমেল ঘোষ: ৩৯তম (বিশেষ) বিসিএস ছিল আমার জীবনের প্রথম বিসিএস। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমার চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষার মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা সমাপ্ত হয়। এরপর এপ্রিল মাসে আমি বাসায় আসি। যেদিন আমি বাসায় আসি, সেদিন বিকেলেই আমি টেলিভিশনে সংবাদ দেখতে পাই যে ৩৯তম (বিশেষ) বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। তো ফর্ম পূরণ শেষে সিলেবাস সংগ্রহ করে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করি। ইতোমধ্যে চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় এবং ১ জুলাই ২০১৮ থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন শুরু করি। চিকিৎসকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সমানতালে বিসিএসের প্রস্তুতিও নিতে থাকি। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসাবে অনেক বিষয়েরই বেসিক ধারণা পরিষ্কার ছিল আমার কাছে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ৩৯তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখতে পাই যে, আমি মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ৩৯তম বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। এর পরপরই ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করি। ২০১৯ সালের মে মাসে ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিই। সৃষ্টিকর্তার অপার করুণায় এবং সবার আশীর্বাদে আমি প্রথমবারেই ৩৯তম বিসিএস পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১৬৭তম হয়ে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হই। এমনকি ৪০তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারিতেও সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হই। ৩৯তম বিসিএসে (স্বাস্থ্য) চূড়ান্তভাবে মনোনীত হওয়ায় পরবর্তীতে আর ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি।


কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?
ডা. হিমেল ঘোষ: ছোটবেলা থেকেই বাবাকে চিকিৎসক হিসাবে দেখতে দেখতে নিজেকে ভবিষ্যৎ চিকিৎসক হিসাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করি। এজন্য চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্ব পালনের অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বরেণ্য অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ স্যার, অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন প্রমুখ স্যারদের সান্নিধ্যে এসে সরকারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসাবে জনগণের সেবা করার অনুপ্রেরণা পাই। এ ছাড়াও আমার কাছের অনেক বন্ধু-বান্ধব এবং সিনিয়র ভাইয়ারাও আমাকে সব সময় উৎসাহিত করেছেন।


ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ডা. হিমেল ঘোষ: আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো- একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসাবে জনগণের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। এজন্য স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বিশেষায়ন ও সঠিক সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তার স্বপ্ন দেখি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মেডিসিন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান জনকল্যাণে কাজে লাগাতে চাই। দেশের সব মানুষ যেন যথাযথ চিকিৎসা সেবা পায়, সুস্থ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে পারে। এ লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়াই আমার স্বপ্ন।

সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?
ডা. হিমেল ঘোষ: সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে একজন সম্মুখ যোদ্ধা হিসাবে আমি প্রথম সারিতেই আছি। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সঠিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য সপ্তাহে ৭ দিনই আমি কাজ করে যাচ্ছি। একদিকে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি যেন সুচিকিৎসা পান এটা নিশ্চিত করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে রাত-দিন জনগণের সেবায় নিয়োজিত আছি। অন্যদিকে করোনাভাইরাস নিয়ে সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য অনলাইন-অফলাইন, পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত স্বাস্থ্যবার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। পাশাপাশি দুর্যোগকালীন কোন অসুস্থ ব্যক্তি যেন সঠিক চিকিৎসাসেবা পান, এ লক্ষ্যে আমি টেলিমেডিসিন সেবাও চালু রেখেছি। সবাইকে সাথে নিয়ে অবশ্যই আমরা এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব।

মন্তব্যসমূহ