একসময়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী হলেও আপাতত সে খেতাব তার নেই। তবুও এখনো অঢেল সম্পদের মালিক বিল গেটস। ফোর্বস-এর তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল ২০২২ সাল পর্যন্ত বিল গেটসের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিল গেটস এত সম্পদের মালিক হলেন কী করে এ নিয়ে মানুষের আগ্রহের অন্ত নেই। এ কথা অনস্বীকার্য নিজের মেধা, পরিশ্রম দিয়েই তিনি আজ এ পর্যায়ে পৌঁছেছেন। কিন্তু তার কিছু অভ্যাসও তাকে শতকোটিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছে। জেনে নেওয়া যাক এরকম ১৩টি অভ্যাসের কথা।
জ্ঞানের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল পড়েছিলেন বিল গেটস। এরপর ড্রপ আউট হন। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অল্প কয়েকটি দিনকেও নিজের সাফল্যের পেছনে প্রভাব রেখেছে বলে কৃতিত্ব দেন গেটস।
হার্ভার্ডে কম্পিউটারবিদ্যা শিখলেও অন্যান্য অনেক বিষয়েও জ্ঞান অর্জনে রত ছিলেন গেটস। নিজের কোর্সের বাইরেও অন্য অনেক টিচারের ক্লাস করতেন তিনি।
নিজের এ জ্ঞানতৃষ্ণা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন বিল গেটস। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে গ্লোবাল এডুকেশন প্রোগ্রাম চালু করা হয়। এ প্রোগ্রামের আওতায় সাব-সাহারান আফ্রিকা ও ভারতের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বাচ্চাদের পড়া ও গণিতের দক্ষতা শেখানো হয়।
ছিল মা-বাবার সমর্থন
১৯৯৮ সালে বিল গেটস জানিয়েছিলেন তার রোল মডেল হচ্ছে তার মা-বাবা। কম্পিউটার নিয়ে বিল গেটসের আগ্রহের পেছনে উৎসাহ দিয়েছিলেন তার মা-বাবাই, এমনকি হার্ভার্ড ছাড়ার পরেও সে সমর্থন জুগিয়ে গিয়েছিলেন এ দুইজন।
মায়ের কল্যাণেই আইবিএম-এর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে গেটসের। বাবার কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন মানবহিতৈষী কাজের ধারণা। ছেলের এ ধরনের দানধ্যানে প্রত্যক্ষ সহায়তা করতেন সিনিয়র গেটস।
প্রচুর পড়েন গেটস
ফোর্বস-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বিল গেটসের বাবা জানিয়েছিলেন, তারা ছেলে ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তো। বই পড়ার ক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার ছিল না গেটসের।
এখনো নিয়মিত বই পড়েন গেটস। ২০২১ সালে এক টুইটে তিনি জানিয়েছেন, অফিসে প্রচুর কাজের চাপ হোক বা বাইরে একটু হাঁটতে বের হওয়া, বই পড়তে তিনি সবসময় চেষ্টা করেন। বই পড়ার মাধ্যমে নতুন নতুন জিনিস শেখা ও পৃথিবীটাকে আরও একটু ভালো করে বোঝা যায় বলে মনে করেন বিল গেটস।
তার ব্যাবসায়িক-পার্টনার ছিলেন চমৎকার
১৯৯৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে বিল গেটস বলেছিলেন, 'আমি বলব, আমার ব্যবসায়-সংক্রান্ত ভালো সিদ্ধান্তগুলোর সাথে সঠিক মানুষদের নির্বাচন করার ব্যাপারটি জড়িয়ে আছে।' এর মধ্যে পল অ্যালেনের সাথে পার্টনারশিপ গড়ে তোলাকে তালিকায় সবার ওপরে রেখেছেন গেটস।
পল অ্যালেন ও বিল গেটস ছোটবেলা থেকেই বন্ধু ছিলেন। ১৯৭৫ সালে একত্রে মাইক্রোসফট গড়ে তোলেন এ জুটি।
নিজের কাজে প্রগাঢ় উৎসাহ গেটসের
সফল হতে হলে কাজকে ভালোবাসতে হবে। একথা অনেক উদ্যোক্তাই মানেন। বিল গেটসের ছোটবেলা থেকে কম্পিউটারের প্রতি মুগ্ধতা ছিল। বড় হয়ে তাই নিজের কাজকে ভালোবাসতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি।
গেটসের ভাষায়, 'প্রতিদিন যে কাজটা করেন সেটা আপনাকে উপভোগ করতে হবে। আমার জন্য এ উপভোগের জায়গাটা হলো আমি খুবই স্মার্ট কিছু মানুষজনের সাথে কাজ করি।'
নিজের স্বপ্ন নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন গেটস
লেকসাইড স্কুলে পড়তেন গেটস। এটি ছিল একটি ব্যয়বহুল প্রাইভেট স্কুল। ওখানে পড়ার সুবাদে ক্লাস সেভেনে থাকতেই কম্পিউটারের সংস্পর্শে আসেন গেটস।
ওই স্কুলে ধরাবাঁধা শেখানোর সময়ের বাইরেও শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারতো। সেসময় গেটসের এখনকার সফলতা অবাস্তব শোনানোই স্বাভাবিক ছিল। গেটস মনে করেন, ওই স্কুলে কম্পিউটার নিয়ে অভিজ্ঞতাই তাকে ভবিষ্যতের কাজে উৎসাহ জুগিয়েছে।
মাইক্রোসফট-এর জন্য আপৎকালীন তহবিল
অনেক দ্রুতই গেটস বুঝতে পেরেছিলেন, সাফল্য পেতে হলে তাকে মাইক্রোসফট-এর জন্য একটি আপৎকালীন তহবিলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
২০১৮ সালে এক চ্যাট শো-তে গেটস জানিয়েছিলেন, তিনি সবসময় সতর্ক ছিলেন যাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লোককে নিয়োগ না দিয়ে ফেলেন। তার কর্মীদের বেতন-ভাতা যেন কখনো আটকে না যায় সেদিকেও যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হতো তাকে।
ভুল থেকে শিক্ষা
সবাই ভুল করে, বিল গেটসও তার ব্যত্যয় নয়। তবে ভুল থেকে শিখতে পারাটাই হচ্ছে কাজের কথা। আর সেটা খুব ভালোভাবে করে দেখিয়েছেন বিল গেটস।
২০১৯-এ বিল গেটস স্বীকার করেছিলেন, অ্যাপল আইফোন বাজারে ছাড়ার পরে অ্যাপল-এর সাথে প্রতিযোগিতায় না যাওয়াটা তার ও মাইক্রোসফট-এর জন্য সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।
সাত ঘণ্টা ঘুমান গেটস
অনেক বিলিয়নিয়ার বড়াই করতে ভালোবাসেন তারা কত কম ঘুমান তা নিয়ে। কিন্তু বিল গেটস তার উল্টোটা৷ তিনি সাত ঘণ্টা ঘুমানোর পক্ষে, কারণ কাজরে ক্ষেত্রে সৃজনশীল হতে হলে পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।
চারপাশের মানুষ থেকে শেখেন গেটস
১৯৯২ সালে আরেক ধনকুবের ওয়ারেন বাফেটের সাথে পরিচয় হয় গেটসের। এরপর তারা বন্ধু বনে যান। ২০২০ সালে এক ব্লগ পোস্টে বাফেটের ৯০ তম জন্মদিন ও তাদের বন্ধুতা উদযাপন করেন গেটস।
সেখানে তিনি লিখেন, "ওয়ারেন আমাকে বলেছিলেন, 'আপনি যাদের সাথে মিল পান, তাদের সাথেই মিশবেন। তাই যারা আপনার চেয়ে ভালো, তাদের সাথে মেশা গুরুত্বপূর্ণ।'''
ব্যক্তিগত পোর্টফোলিওর বৈচিত্র্য
মাইক্রোসফটকে সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পর সেখানেই থিতু হয়ে যাননি বিল গেটস। এরপর আরও অন্যান্য কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন তিনি।
কানাডিয়ান ন্যাশনাল রেলওয়ে, অটোনেশন ইত্যাদি কোম্পানিতে গেটসের শেয়ার রয়েছে। আমেরিকার কৃষিজমির একজন বড় মালিক বিল গেটস। এছাড়া আরও অনেকগুলো কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে বিল গেটসের। এভাবে বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে নিজের অভিজ্ঞতা আর পোর্টফোলিও, দুটোতেই বিচিত্রতা এনেছেন তিনি।
পার্টনারশিপ ছাড়ার সঠিক সময় জানতেন গেটস
১৯৮০-এর দশকে আইবিএম-এর সাথে যুক্ত হয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তিতে বিপ্লব আনে মাইক্রোসফট। এরপর ১৯৯০-এর দশকে এসে গেটস ঠিক করলেন, এখন থেকে মাইক্রোসফট একা চললেই তা কোম্পানির জন্য ভালো হবে।
কিছুটা জুয়া খেলার মতো আইবিএম থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিল গেটস। তার জুয়ার দান ভালোভাবেই লেগেছিল। আইবিএম থেকে পার্টনারশিপ শেষ করার সময় মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ও এমস-ডিওএস সফটওয়্যারগুলো পায়। এগুলো দিয়েই ভাগ্য খুলে গিয়েছিল মাইক্রোসফট-এর।
নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে শিখেছিলেন গেটস
২০১৯ সালে নিজের কর্মীদের বিশ্বাস করে তাদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করার পর আরও সাফল্য ধরা দেয় গেটসের হাতে।
মাইক্রোসফট-এর প্রাথমিক সময়ে নিজেই সবকিছু দেখাশোনা করতেন বিল গেটস। পরে একসময় প্রধান প্রধান কর্মীদের সাথে ভালো বোঝাপড়া গড়েন গেটস। তাদের হাতে অনেক গুরুদায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজে ক্ষেত্রবিশেষে মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন তিনি।
নিজের কাজ নিয়ে এখনো প্যাশনেট বিল গেটস
প্রায় এক দশক আগে মাইক্রোসফট-এ দৈনিক কাজ করা ছেড়ে দেন বিল গেটস। তারপর কোম্পানিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০২০ সালে মানবহিতৈষী কাজে নিজেকে পুরোপুরি নিযুক্ত করার জন্য মাইক্রোসফট-এর সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন বিল গেটস।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে গেটস আবারও একজন পরামর্শক হিসেবে আবির্ভূত হন। সরকারের বিভিন্ন বিজ্ঞান-ভিত্তিক নীতিমালা প্রসঙ্গে সোচ্চার হন তিনি। এছাড়া করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে গবেষণা, টিকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কয়েক মিলিয়ন ডলার দান করেছেন তিনি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন